গল্প- তোরা ভালো থাকিস

তোরা ভালো থাকিস
-অঞ্জনা গোড়িয়া

সেদিন ছিল আমার দ্বিতীয় ভ্যাক্সিনের দিন।
ভোটকর্মী তো তাই আগেই সুযোগটা পেয়েছি।
পৌঁছে দেখি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের বাইরে গেটে বিরাট লাইন। বয়স্ক সব বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা ছাতা মাথায় হাতে একটা পুঁটুলী নিয়ে বিষন্ন মুখে দাঁড়িয়ে। একটু অস্বস্তিতে ওখান থেকে বেরিয়ে এলাম ফাঁকা মাঠে।
আরও একটু এগিয়ে এলাম।
স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ঠিক পিছনেই একটা বিরাট বটগাছ। বৈশাখী রোদের তেজ তেমন এখানে ছিল না। জায়গাটা বেশ ঠান্ডা। বটের ছায়ায় কিছু মানুষ বিশ্রাম নিচ্ছে। এনারাও এসেছেন ভ্যাক্সিন নিতে। সবাই খুব চিন্তিত। আজ কী সত্যিই পাওয়া যাবে ভ্যাক্সিন? নাকি শূন্য হাতে ফিরতে হবে বাড়ি? কারণ ভ্যাক্সিনের পরিমাণ খুব সীমিত।
বটের নীচে একটা বড়ো দিঘি। সেদিকেই চলে গেল চোখ দু’টো। দেখি কিছু ছেলে মেয়ে মনের আনন্দে সাঁতার কাটছে। ইচ্ছে মতো ডুব দিচ্ছে। তাদের মায়েরা দিঘির ঘাটেই কাদামাটি দিয়ে বাসন মাজছে।
বারবার করে ডাকছে। এবার ওঠ রে তোরা। ঠান্ডা লাগলে জ্বর আসবে। আর জ্বর হলে কী জানি কি হবে? উঠে আয় রে।
কে কার কথা শোনে।
একজন জল থেকেই চেঁচিয়ে উঠলো, এখন তো স্কুল ছুটি। কী করবো তাড়াতাড়ি উঠে?
সেই তো একই কাজ। ভাত খাও রে। ঘুমাও রে। বিকালে একটু খেলতে যাবো যে, তারও জো নেই। আমরা করবোটা কি? একটু জলেই খেলা করি? এখানে তো আর করোনা আসবে না। কী বলো মা? খিলখিল করে হেসে আবার একটা ডুব।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিলাম ওদের কথা। বেশ লাগছিল। সত্যিই তো কী করবে এরা?
স্কুল ছুটি। পড়াশোনা না করলেও ক্ষতি নেই। মনের আনন্দে ডুব সাঁতার কাটছে এরা।
হাতে ছিল ফোন। লোভ সামলাতে পারলাম না। তুলে রাখলাম নবপ্রজন্মের সাঁতারুদের ছবি।
হঠাৎ একজন চেঁচিয়ে উঠলো, এই এই তোর মাথা থেকে রক্ত পড়ছে। নিশ্চয় মাথা ফেটেছে।
ছেলেটা মাথাটা চেপে ধরে উঠে এল ডাঙায়। তবু চোখে নেই জল। নেই কান্নার আওয়াজ। মা ভয়ে অস্থির।
ছেলে নিজেই বললো, এত ভেবো না তো। মনে হয় ইটের টুকরো লেগে একটু কেটেছে। এই রামু কিছু ঘাস পাতা ছিঁড়ে আনতো। রস করে লাগিয়ে দিলে এক্ষুনি রক্ত পড়া বন্ধ হবে।
একজন ছুটে গিয়ে কী যেন গাছের পাতা ছিঁড়ে রস বের করে লাগিয়ে দিল মাথায়।
ব্যস ছেলেটা খুশিতে ডগমগ। আবার একটা ডুব।
চলে এলাম ভ্যাক্সিন নিতে। সারি সারি বয়স্ক মানুষের ভীড়। ভীষণ খারাপ লাগছিল। এত মানুষের মাঝে আমার ভ্যাক্সিন নিতে সত্যিই খুব খারাপ লাগছিল।
একটু ভালো করে বাঁচার তাগিদে মানুষের কী নিদারুণ লড়াই। জানি আমরা জিতবো। লড়াইয়ে আমরা জিতবোই।
ভ্যাক্সিন নিয়ে আধঘন্টা বিশ্রাম। এবার ফেরার পালা।
তখন বেলা দু’টো। দিঘির জলে চরে বেরাচ্ছে হাঁস। বটের ছায়ায় মনের খুশিতে ঘাস পাতা খাচ্ছে কয়েকটি গরু ছাগল।
হেলথ সেন্টারের পাঁচিলের ধারে খেলনাবাটি খেলছে কয়েকজন কচিকাঁচা।
ছোটো বেলার কথা খুব মনে পড়ছে। আমিও এই বয়সে কত পুতুল, রান্নাবাটি খেলেছি।
কত যুগ পেরিয়ে এসেছি।
তবু ভুলতে পারি নি আজও। সেই মেয়েবেলাটা।
কী সুন্দর কাদামাটি দিয়ে মাটির উনুন গড়েছে। পাশেই আছে মাটির হাঁড়ি, কড়াই খুন্তি। আজ নাকি ওদের ফিস্টি। একজন আনাজখোলা নিয়ে নারকেলের মালায় তরকারি সাজিয়ে রেখেছে। কী যে ভালো লাগছিল।
আর একদল কচিকাঁচা তখন বটের ডালে ঝুলছে। লাল লাল ফলে ভরে আছে গাছ। তারই ফাঁকে ফাঁকে দুলছে দোলনায় কচিকাঁচারা। এমন দৃশ্য দেখে ছবি তুলবো না। তা কি হয়? যেই ফোনটা বের করেছি, অমনি ছুটে এলো দু’টো ছেলে। একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। তোতলে তোতলে বললো, দিদি দিদি তুমি আমাদের ছবি তুলছো?
আমার একটা সেল্ফি তুলে দেবে গো?
এমন মিষ্টি আবদার আমি কী না রেখে পারি?
সবাইকে বললাম, ছবি তুলতে পারি। কিন্তু আমার শর্ত মানতে হবে।
সবাই এক বাক্যে বললো,শর্ত? সে আবার কী? আগে তো ছবি তোলো। যা বলবে তাই শুনবো। বেশ।
তবে শোনো, কাল থেকে সবাই মুখে মাস্ক পড়বে। ভালো করে গা হাত পা ধুয়ে পরিস্কার হয়ে তবেই বাড়ি ফিরবে। আর দুপুরে যে যার বাড়ির ভেতরে থাকবে। জানো তো একটা দুষ্টু রাক্ষস এসেছে।
সরল সাদাসিধা ছেলেমেয়েগুলো করুণ চোখে তাকিয়ে বললো, আর কত দিন ঘরে থাকবো? শুনি? ভাল্লাগে না। ঘরে থাকতে। আর স্কুলেও যাই না। আমরা করবোটা কী? বলো কবে স্কুলে যাবো?
ছোট্ট একটা প্রশ্নের ধাক্কায় মুখটা নিচু করে নিলাম।
ফোনবন্দী করলাম সবার সরল মুখগুলো।
ফেরার সময় বলে এলাম, তোরা ভালো থাকিস। সুস্থ থাকিস। একদিন নিশ্চয়ই স্কুলে যাবি। আবার দেখা হবে। তোরা ভালো থাকিস।

Loading

Leave A Comment